বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৩১ পূর্বাহ্ন
শাহীন হাসনাত:
দিন দিন বদলে যাচ্ছে মানুষ। নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তরিকতা, মমতা, স্নেহ ও ভালোবাসা কমে আসছে। এসব কারণে শহর তো দূরের কথা, গ্রামেও ১০ ভাগের কম যৌথ পরিবার টিকে আছে। সন্তানরা বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বামী-স্ত্রীর একক পরিবার গড়ে তুলছে। এভাবে যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে পরিবার ও আত্মীয়তার বন্ধন। বাবা-মা হয়ে উঠছেন অনেকের জন্য বাড়তি ঝামেলা। সন্তান একাধিক হলে বাবা-মা কার কাছে থাকবে, কোথায় থাকবে এসব নিয়ে আলোচনা, তর্কবিতর্ক ও সংসারে অশান্তির জেরে শেষ বয়সে অনেক প্রবীণ পরিবার-পরিজন ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাচ্ছেন। অনেক সময় সন্তানও নানা যুক্তিতে বাবা-মাকে তাদের সম্মতি সাপেক্ষে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছে। ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি, বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেওয়া প্রবীণদের বেশিরভাগই উচ্চশিক্ষিত ও বিত্তশালী পরিবারের। এদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও রয়েছেন। যাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে পরিবার থেকে প্রত্যাখ্যাত। ফলে সম্মানের ভয়ে শেষ ভরসা হিসেবে বৃদ্ধাশ্রমকে বেছে নিয়েছেন। বার্ধক্য মানবজীবনের এক অনিবার্য বাস্তবতা। কোরআনে কারিমে খুব সংক্ষেপে এর স্বরূপ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন দুর্বল অবস্থায়, দুর্বলতার পর তিনি দেন শক্তি, শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’ -সুরা রুম: ৫৪
বার্ধক্য মানেই নানাবিধ দুর্বলতা। তাই বার্ধক্যপীড়িত মানুষের প্রতি সচেতনতা ও সহানুভূতি থাকা প্রয়োজন। এজন্য দরকার গভীর মানবিক শিক্ষা। কোরআন-হাদিসের শিক্ষা মানুষকে এই চেতনা দান করে। বার্ধক্য জীবনের একটি পর্ব; বেঁচে থাকলে যে পর্ব প্রত্যেকের জীবনেই আসবে। তাই প্রবীণদের প্রতি একজন মুসলিমের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, ইসলাম তা বলে দিয়েছে। সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো পরস্পর প্রীতি ও সৌহার্দ্য। এজন্য গোটা মুসলিম জাতিকে হাদিসে এক দেহের মতো বলা হয়েছে যার একটি অঙ্গ রোগাক্রান্ত হলে গোটা দেহ আরাম-নিদ্রা ত্যাগ করে। ইসলাম সমাজ ব্যবস্থায় পরস্পর সহযোগিতা, একে অন্যের সেবা ও প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসাকে যেমন গুরুত্ব দেয়, তেমনি বড়কে মান্য করার গুরুত্ব দেয়। হাদিসে বড়কে মান্য, শ্রদ্ধা ও সম্মান করার তাগিদ এসেছে। এমনকি যে বড়কে সম্মান করে না এবং ছোটকে স্নেহ করে না, আল্লাহর রাসুল (সা.) তার সম্পর্কে ‘সে আমাদের নয়’ বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। ইসলামে মা-বাবার সেবা ও সদাচারের প্রতি অতিমাত্রায় তাগাদা দেওয়া হয়েছে। এই সেবা ও সদাচারকে অনন্য মর্যাদায় ঘোষণা করে বলা হয়েছে, মা-বাবার প্রতি উদাসীন কেউ; ভালো ইমানদার হতে পারবে না। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া অন্য কারও উপাসনা কোরো না এবং তোমরা পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহলে তুমি তাদের প্রতি ‘উহ’ শব্দটিও কোরো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না। আর তাদের সঙ্গে নরমভাবে কথা বলো। তাদের প্রতি মমতাবশে নম্রতার ডানা অবনমিত করো এবং বলো, হে আমার প্রতিপালক! আপনি তাদের প্রতি দয়া করুন যেমন তারা আমাকে ছোটকালে প্রতিপালন করেছিলেন।’ -সুরা বনি ইসরাঈল : ২৩-২৪
ইসলামে মা-বাবার সঙ্গে সদাচার বিষয়ে এটাও বলা হয়েছে, মা-বাবার বন্ধু-স্থানীয়দের সঙ্গে সদাচার ও সুসম্পর্ক রাখতে হবে। এই শিক্ষা আমাদের পূর্বসূরিদের বাস্তব জীবনে ছিল বলেই তাদের জীবন মানবতা ও মানবিকতায় উদ্ভাসিত ছিল। তারা যেমন বৃদ্ধের সেবা ও সম্মান করেছেন তেমনি নিজের বার্ধক্যেও তারা পেয়েছেন নবীন প্রজন্মের অপরিমেয় সম্মান ও সেবা।
মনে রাখতে হবে, প্রবীণরা আমাদেরই পিতা-মাতা কিংবা গুরুজন। তাদের রয়েছে পারিবারিক ও সামাজিক অধিকার। তাদের অধিকার সুরক্ষা আমাদের নৈতিক, সামাজিক ও ইমানি দায়িত্ব। সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনিদের সঙ্গ পাওয়া, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও যোগাযোগ করা এবং পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা প্রবীণের অধিকার। প্রবীণদের সন্তুষ্টি বেহেশতের সিঁড়ি ও সাফল্যের সোপান। সুতরাং তাদের ঠাঁই বৃদ্ধাশ্রমে নয়, নিজ নিজ পরিবারে হোক।সূত্র: দেশরূপান্তর।
লেখক : মুফতি ও ইসলামবিষয়ক লেখক